কৃষিবিদ কে এম মাসুম বিল্লাহ, কলামিস্ট, ব্যাংক কর্মকর্তা (বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক)
পাক-ভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশ কলোনী থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশদের কলোনি থেকে স্বাধীনতা লাভ করা কোনো দেশই পরবর্তীতে ব্রিটিশদের নোংরা রাজনিতীর শিকার হয়নি এমনকি ব্রিটিশরা এমন কোনো চুক্তিও করেনি এসব দেশগুলোর সাথে যার মাধ্যমে পরবর্তীতে ঐসমস্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যূতে নাক গলানো যায়। কিন্তু এর পুরোপুরিও ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যায় ফরাসীদের কলোনি থেকে স্বাধীনতা লাভ করা দেশগুলোতে। ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বলতে ১৭শ শতক থেকে ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত ইউরোপের বাইরের যেসমস্ত অঞ্চল ফ্রান্সের অধীনে ছিল, তাদেরকে বোঝায়। ভূমির ক্ষেত্রফলের হিসাব অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সাম্রাজ্যটি এর বিস্তারের চরমে পৌঁছেছিল; ঐ সময় সাম্রাজ্যের আয়তন দাঁড়ায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। অাফ্রিকার অধিকাংশ দেশগুলো ছিলো ফরাসী কলোনীর অন্তর্গত। আর এসমস্ত দেশগুলোকে শোষণের নামে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিনত করেছে ফ্রান্স।বিশ্বে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের পরিচয় শিল্পকলা, চলচ্চিত্র আর সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। সেই পরিচয়ের ছিটেফোঁটাও সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলোর ভাগ্যে জোটেনি।
আফ্রিকা ও এশিয়াজুড়ে প্রায় দুই শতাব্দীর ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনকালে ফ্রান্স মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, তৎকালীন ইন্দোচীন বলে পরিচিত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়।
আফ্রিকা প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এক মহাদেশ, যাকে কিনা অলংকারে সজ্জিত গরীবের বধূর সাথে তুলনা করা যায়। উপনিবেশের নামে এসমস্ত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নিজেদের ভোগ্য পন্য বানিয়েছে তারা। এমনকি স্বাধীনতা দেয়ার নামে অধিকাংশ দেশকে পরোক্ষভাবে গোলাম বানিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাছিল করে চলছে ইউরোপের তথা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি এ দেশটি। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেয়া হয় ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে তবে এসব দেশের সাথে করা হয় অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি। আফ্রিকার ২৪ টি দেশের সাথে অর্থনৈতিক এ চুক্তি এক কথায় ফ্রান্সের অমানবিক ও বর্বর পরিচয় বহন করে। ফ্রান্স এসমস্ত দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্যতার সুযোগ নেয়। এ চুক্তির মাধ্যমে এসমস্ত দেশের জাতীয় আয় জমা রাখা হয় FCFA (Franc for France African) নামক ব্যাংকে, এবং করা হয় সব অসামঞ্জস্য চুক্তি। যেসব দেশ নিজেদের অর্জিত আয় এ ব্যাংক জমা রাখছে আর তারা কিনা ১৫% এর বেশি টাকা তোলার অধিকার রাখেনা! এমনকি এর বেশি টাকা নিতে চাইলে কমার্শিয়াল রেটে ঋণ নিতে হয়! অর্থাৎ নিজেদের টাকা নিজেদেরকেই ঋণ নিতে হয়, এবং ঋণ নেয়ার পরিমান কখনো ২০% এর বেশি হতে পারবে না। অাফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর অর্জিত টাকা নিজেদের প্রয়োজনে বিনিয়োগ করে থাকে ফ্রান্স, এই বিনিয়োগের পরিমান প্রায় ৮০% এবং এর লভ্যাংশও নিজেরা ব্যবহার করে, কোনো লভাংশ্য আফ্রিকার দেশগুলোকে দেয় হয় না! এই ১৪টি দেশে প্রাপ্ত বা আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক বা খনিজ সম্পদ কেনার বা না কেনার প্রাথমিক অধিকারও ফ্রান্সের। অন্য দেশ বেশি দাম দিলেও তাদের বেচা যাবে না। সরকারি কাজের ঠিকা দিতে হবে ফরাসি সংস্থাগুলিকেই।
সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেঁরা ১৯৫৭ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আফ্রিকার উপর নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে না পারলে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ফ্রান্সের কোনো জায়গা থাকবে না। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ তাদের অর্জিত অর্থ ফ্রান্সের হাতে তুলে দিচ্ছে আর সেই অর্থ দিয়ে ফ্রান্সের সাম্রাজ্য একটু একটু করে বেড়ে চলছে, অপরদিকে অাফ্রিকার শিশুরা না খেয়ে দিনযাপন করছে। একটু ভালো জীবনের আশায় আফ্রিকানরা সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে অথবা সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একটি জরিপে দেখা যায় অভিবাসীদের অধিকাংশই এই ২৪ টি আফ্রিকান দেশের অধিবাসী।
বিভিন্ন সময়ে এসব অসামঞ্জস্যতা ও স্বাধীন সার্বোভৌমত্ব রক্ষায় সোচ্চার হওয়া আফ্রিকান ২২ জন প্রেসিডেন্টকে কৌশলে হত্যা করে ফ্রান্স।আফ্রিকাকে নিজেদের অধীনে রাখতে সর্বক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএসই। ডিএসটি নামের অপর একটি সংস্থা কাজ করে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও বাহিরের নিরাপত্তা রক্ষায়। ফ্রান্স যাতে অভিবাসী সমস্যায় না পড়ে সেজন্যও কাজ করে এই সংস্থাটি। ডিজিএসই, ডিএসটি এবং এসডিইসিই নামের সংস্থাগুলো ছাড়া ফ্রান্সের মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘর্ষে অপপ্রচার চালাতে কাজ করে।
উপনিবেশগুলোর মানুষের জীবনমান ও অগ্রসরতা নিয়ে উদ্বেগ না থাকলেও অবশ্য ফ্রান্স এখনও বহু দরিদ্র আফ্রিকান দেশকে কর ও ভাড়া দিতে বাধ্য করছে। এর মাঝে ১০টি দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে শিক্ষাহার পুরো বিশ্বের মাঝে সবচেয়ে কম। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষাহারসহ হতভাগ্য দেশগুলোর মধ্যে ৮টি দেশের দিকে নজর দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এই ৮ দেশ হলো; বেনিন (৪০%), বুর্কিনা ফাসো (২৬%), চাদ (৩৪%), আইভরি কোস্ট (৪৯%), গায়ানা (২৯%), মালি (২৩%), নাইজার (২৯%) এবং সেনেগাল (৪২%)। সিজিএস গ্লোবের খবর অনুযায়ী, ফ্রান্স তার কলোনিতে পূর্বে তাদের দ্বারা নির্মিত অবকাঠামোগুলোর জন্য ভাড়া নিয়ে থাকে।
১৯৯০’এর দশকে যখন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন প্রত্যেকটি দেশেই শতভাগ শিক্ষার হার ছিল। একটি দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শুধু শিক্ষাহার নয় সোভিয়েত শাসনামলের অবসান হওয়ার সময় এদেশগুলোতে ছিল হাজার হাজার সুপ্রশিক্ষিত চিকিৎসক আর প্রকৌশলী। সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল মানসম্মত বহু বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসন এলাকা। একই কথা বলা যেতে পারে যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন অবকাঠামো স্থাপনের ক্ষেত্রে। ব্রিটিশরাও পাক-ভারত উপমহাদেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ নির্মান করে মানসম্মত শিক্ষার জন্য। কিন্তু ফ্রান্সের কলোনির অন্তর্গত দেশগুলোর অধিকাংশরই শিক্ষার হার সর্বনিম্ন। এসব তথ্য একটা কথাই প্রমান করে, ফ্রান্স মুক্তমনা চিন্তা ও সভ্যতার মুখোষে যেনো এক ভয়ংকর চরিত্র।
আফ্রিকায় হয়তো একদিন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব হবে, স্বাধীনতার নামে গোলাম বনে যাওয়া আফ্রিকার নতুন প্রজন্ম হয়তো প্রচন্ড ঘৃনা করবে সভ্য দেশ হিসেবে খ্যাত ফ্রান্সকে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবে কিভাবে তাদের সম্পদকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লুট করেছে ফরাসীরা। আফ্রিকানদের এই অভিশাপে হয়তো একদিন ভেঙ্গে পরবে ফরাসীদের।