একটা সময় পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানকে ত্যাজ্যপুত্র করা হতো।আত্মীয়-স্বজন পাড়াপড়শি বয়কট করত।একালে পরিবারের সন্তান বখে গেলে নষ্ট সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে দাম্ভিক আচরণে সমাজে অন্যায় অসংগতি করলে তাকে সবাই সমীহ করে।পরিবার আত্মীয়-স্বজন তাকে নিয়ে গর্ব করে।
একসময় বাড়ির মেধাবী ছেলেটিকে মাছের মাথা তুলে দেওয়া হতো।এখন পরিবারসহ আশপাশে সবাই সমীহ করে উগ্র বেয়াদব বখাটেকে।যে নেতাদের সঙ্গে মোটরসাইকেল মহড়ায় ব্যস্ত সময় যত কাটায় তার কদর বেশি হয়।এভাবেই গোটা সমাজটাকে চোখের সামনে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।এভাবেই নষ্ট হতে দেখছি চোখের সামনে।
এক সময় যাত্রাপালার কাহিনির বিষাদ ছায়ায় হঠাৎ উদয় হতেন বিবেক।মানুষকে জাগিয়ে তুলতে বিবেকের আহ্বানে দর্শকদের চোখ ছলছল করে উঠত।অনেকে চোখের পানি ফেলতেন নীরবে।কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে উঠতেন।‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ যাত্রা হতো সারা দেশে।সিনেমার পাশাপাশি আনোয়ার হোসেন যাত্রায়ও অভিনয় করতেন সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে।
ভরাট কণ্ঠে কঠিনতম খারাপ সময়ে আলেয়ার সঙ্গে বলতেন ভিতরের কষ্টের কথা।পর্দা নেমে যেত।মঞ্চে আসতেন বিবেক।বিবেকের কেঁপে ওঠা কণ্ঠ কাঁদাত দর্শককে।আবেগ আপ্লুত হতো সবাই।শুধু সিরাজউদ্দৌলা নয়,সব যাত্রাপালায় বিবেক আসত।এখন যাত্রাপালা হয় না,বিবেকও নেই।বিবেকের বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠও স্তব্ধ।
এখন সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না।ঝলসে ওঠে না হুমায়ুন আজাদের মতো কোনো শিক্ষকের কলম।দলীয় রাজনীতি বিবেককে শেষ করে দিয়েছে।চোখকে করে দিয়েছে অন্ধ।
শিক্ষক,সাংবাদিক,কবি,সংস্কৃতিসেবী, সিভিল সোসাইটি,নারীনেত্রী সবাই কথা বলেন হিসাব-নিকাশ কষে।কে খুশি,কে বেজার হবেন সেই চিন্তা।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যের কুৎসা রটানো নিয়ে ব্যস্ত আরেক দল।সমাজ নিয়ে কথা বলার মানুষ কমে যাচ্ছে।
ডিজিটাল দুনিয়া আমাদের আবেগ কেড়ে নিয়েছে।অনাচার বাড়িয়েছে।বিবেককে শেষ করে দিয়েছে।সমাজ,সংসারে নীরবে ছড়িয়ে দিয়েছে হিংসা-বিদ্বেষ।ঘাটে ঘাটে অনাচার।রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ।
সামাজিক নৈতিক অবক্ষয়ের একটি যুগে বাস করছি আমরা।পারিবারিক মূল্যবোধের দিন শেষ।আগে গ্রাম,শহর সবখানের চেহারা আলাদা ছিলো কবিগান,জারিগান,যাত্রাপালা হতো গ্রামগঞ্জে।শরিয়ত-মারফত নিয়ে গানে গানে লড়াই হতো।মানুষ সারা রাত বসে বসে দেখত।পুঁথিপাঠের আসর বসাত অনেকে।মানুষের মাঝে সুস্থতা ছিল।এক বাড়ির বিপদে ছুটে আসত পুরো গ্রামের মানুষ।পারিবারিক,সামাজিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হতো।উঠতি ছেলে বখাটেপনা করলে পাড়া-পড়শিও শাসন করত।চুল বড় রাখলে সতর্ক করত।এখন নিজের সন্তানই বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণে নেই।
বর্তমান সমাজে আদর্শ রাজনীতিবিদ বা আইডলের চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে।অধিকাংশ এলাকার জনসেবার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক বাণিজ্যের রাজত্ব তৈরি করতে গিয়ে এলাকাভিত্তিক তরুণদের বিপথে পরিচালিত হওয়ার তালিম ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন নেতারা।একা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা লড়াই করে কী করবেন?আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি অপরাধপ্রবণ সমাজকে কতটা সামাল দেবে?রাজনীতি ও সমাজে আদর্শিক মূল্যবোধ ও সততার নীতি ফিরিয়ে না আনতে পারলে সামনে ভয়ঙ্কর দিন।
লেখক-সাংবাদিক কলামিস্ট