আত্মহত্যা শব্দটি শুনলে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া। কাগজ-ধুলাবালু উড়ছে। চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। নিজেকে যেন আশপাশের পরিবেশ থেকে গুটিয়ে নিতে হয়। কোনো ঝোড়ো হাওয়া থেকে বাঁচতেই কি মানুষ এই পথ বেছে নেয়?
পৃথিবীর যে অপরূপ সৌন্দর্য, তাকে কি আর কাছে টানে না? কিন্তু গুটিয়ে নেওয়ার পথ কোনো পথ নয়। জীবনের সন্ধানে খুঁজে নিতে হয় কোনো নিরাপদ স্থান। আত্মহত্যা নয়, জীবনের সন্ধানই তাকে দেয় মুক্তির পথ।
কয়েক দিন আগে আমার কাছে একজন ১৮-২০ বছর বয়সী মেয়ে এসেছিল। সঙ্গে বোন আর খালা। ঘুমের ওষুধ আর গলায় দড়ি ঝুলিয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। খালা এসে বাঁচিয়েছিল। কোনো দুর্বলতার মুহূর্তে মেয়েটির সহপাঠীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়। মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে যায়। ছেলেটিকে জানালে সে এড়িয়ে যায়। কয়েক মাস পরে ওর বোন ব্যাপারটি খেয়াল করে। যখন সব জানা গেল, তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে মেয়েটি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পরবর্তীতে অবশ্য বিষয়টি যথাযথভাবে সমাধানও হয়ে যায়।
গতকাল ‘বাগান বিলাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রুপের এডমিন আশিকের’ ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্নহত্যা করার বিষয়টি আমাকে যথেষ্ট আহত করেছে।
জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন বলে তার স্বজনরা ধারনা করছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সবুজে সবুজে শ্যামল করার স্বপ্ন নিয়ে যে যুবক বিভোর থাকতেন সে যুবক কিনা গতকাল মৃত্যুর নেশায় বিভোর ছিলেন।
‘আশিকুল ইসলাম’ বাগান বিলাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামে একটি ফেইসবুক ভিত্তিক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এডমিন এবং এস.বি ট্রাভেলস এর সত্ত্বাধিকারী ছিলেন।
প্রত্যাক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গতকাল রবিবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্নহত্যা করার চেষ্টা করে আশিক। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা পাঠান। তবে ঢাকা যাওয়ার পথে এম্বুলেন্সেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেন ‘আশিক’। এভাবে’ই মৃত্যু হয় একটি সবুজ স্বপ্নের।
আত্নহত্যার কারণ হিসেবে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, উদ্যোগক্তা হিসেবে এস.বি ট্রাভেলস চালাতে গিয়ে মোটা অংকের টাকা লোকশান হওয়ায় বিভিন্ন জায়গা থেকে নেয়া ঋণ ফেরত দিতে না পারার কারণে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন আশিক। যার প্রভাব পড়ে তার ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক জিবনেও। জানা যায়, গত কয়েক মাস আগে ডিভোর্স হয়েছিল তার। বিশেষ করে এই কারণেই জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা ও ডিপ্রেশন থেকে আত্যহত্ন্যার পথ বেছে নেয় ‘আশিক’। এমনটাই ধারণা তার নিকটতম আত্নীয় ও এলাকাবাসীর।
বাগান প্রেমী স্বপ্নবাজ ‘আশিকের’ এই মৃত্যুতে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বিভিন্ন মহলের মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন।
মনোরোগ, মানসিক চাপের কারণে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। বিষণ্নতার ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন এবং নেশার ঘোরে অনেক সময় আত্মহত্যা করে থাকে। মনোরোগ ও চাপ ছাড়াও মান-অভিমান, বিরহ-বেদনা, দারিদ্র্য, যৌতুকপ্রথা, ধর্ষণ, অপমান এসব কারণে অনেকে এই পথ বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে শরীরে সিরোটনিন, ডোপামিন, নন-এড্রেনালিনের ঘাটতি পাওয়া যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, দেশে প্রতিবছর ১৩ হাজার ২৫৮ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত সালের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে এক লাখ মানুষের মধ্যে ৮ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে। খুবই উদ্বেগজনক এই চিত্র। পুলিশের হিসাব বলছে, বছরে চার-পাঁচ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ওদিকে আপন সত্তার বিভ্রমে পড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি। সারা দুনিয়ায় বছরে ৯ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। আর আত্মহত্যার চিন্তায় মনোরোগে ভোগে ১১ কোটি মানুষ। বিষয়টি কিন্তু হেলাফেলার নয়। আত্মহত্যা চিন্তার বেঘোরে থাকা মানুষদের মধ্য থেকেই অনেকে সচেতনতার অভাবে ও পরিবারের অবহেলার জন্য এই পথ বেছে নেয়। সচেতনতাই হলো এই মনোব্যাধির প্রধান ওষুধ।
মনে রাখতে হবে আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। জীবনে চলতে হবে সাহসিকতার সঙ্গে, নির্ভয়ে, নির্ভারে। ছোট এই জীবনটাকে নিজ হাতে আরও ছোট করা কেন? কষ্টকর করা কেন?
‘মনের আকাশে যদি কালো মেঘ উঁকি দেয়, তখন আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা জরুরি’। চারপাশের সমস্যাগুলোকে ছোট মনে করে নিজের জন্য বাঁচতে হবে। অন্যের জন্য নিজে কেন আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন? এটিও ঠিক যে কিছু কিছু সমস্যা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। তবুও নিশ্চয় আত্মহত্যা কোনো সমাধান দিতে পারে না। তিনিই আসল মানুষ, যিনি সমস্যার মধ্যে থেকে তার মোকাবিলা করেন।
পায়ের তলার মাটি শক্ত করা প্রয়োজন। অন্যের ঘাড়ে বোঝা হয়ে না চেপে নিজের প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেওয়া উচিত ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে।
আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটানো। নিয়মিত ব্যায়াম, সাঁতার কাটা, মুক্তমন চিন্তা, বইপড়া তথা আত্মিক উন্নতি সাধন করতে হবে। কোনো সমস্যা নিয়ে বিশেষ ঝামেলায় পড়লে মনের বিভ্রমে ভুগলে কাছের বিশ্বস্ত কারও পরামর্শ নিন। সমাধানের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করুন। তিলকে তাল করা বা কাদাপানি ঘোলা করে এমন পরিস্থিতি বা লোকজন এড়িয়ে চলুন।
আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের মধ্য দেখা যায়, তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন। তাকে বোঝার চেষ্টা করুন। বাঁকা কথা, নেতিবাচক মন্তব্য, মুখ সরিয়ে নিলে নিজেকে এ পৃথিবীতে একা ভাবতে পারে। তার কেউ নেই এ চিন্তা যেন মনের মধ্যে গেঁথে না বসে। তাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। মেয়েটিকে আত্মহত্যার পথ থেকে সরিয়ে আনতে পাছে লোকে কিছু বলে, সামাজিক মর্যাদাহানি এ রকম পুরোনো চিন্তা-চেতনা থেকে পরিবারের সদস্যদেরও বের হয়ে আসতে হবে।